শবেবরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে জানুন
আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে শবেবরাত বা লায়লাতুল
বারাআত বলা হয়। শবেবরাত শব্দটি ফারসি। এর অর্থ হিসসা বা নির্দেশ
পাওয়ার রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি।
এদেশে শবেবরাত সৌভাগ্য রজনী হিসাবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়।
সকল মুসল্লিগণ ধারণা করেন যে এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও
রুজি বরকত করা হয়। সারা বছরের হায়াত মউতের ভাগ্যের রেজিস্টার
লিখিত হয়।
এই রাতে রুহুগুলো সব আত্মীয় স্বজনদের সাথে মুলাকাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে।
আত্মীয়রা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়। হালুয়া রুটির হিড়িক পড়ে
যায়। যারা কখনো সালাতে অভ্যস্ত না তাড়াও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে শালাতে আলফীয়াহ বা
১০০ রাকাত সালাত আদায়ে রত হয়। যেখানে প্রতি রাকাতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পড়া হয়।
তারপর রাত্রির শেষ দিকে সবাই ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেন।
পোস্ট সূচীপত্রঃ শবেবরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে জানুন
শবেবরাতের ফযীলত
পবিত্র হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে এ রাতের ফযীলত অনেক। শবেবরাতের রাতে আল্লাহ্ তাঁর
সকল সৃষ্টির প্রতি বিশেষভাবে চক্ষুশীল করেন এবং সকল মাখলূখকে ক্ষমা করে দেন।
কিন্তু মুশরিককে ও বিদ্বেষকারীদের ক্ষমা করেন না।
কিন্তু অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে রাসুলে করিম (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ শাবানের
পনেরো তারিখ রাতে আল্লাহ্ পাক বান্দাদের দিকে চক্ষুশীল করে মুমিনদেরকে মাফ করে
দেন এবং বিদ্বেষকারীদের তাদের বিদ্বেষ এর মধ্যে ছেড়ে দেন। মানে তাদের মাফ করেন
না। যতক্ষণ না তারা বিদ্বেষ ত্যাগ করে দোয়া করে।
শবেবরাতের কিছু আমল
এই রাত্রির ১০০ রাকআত সালাত সম্পর্কে যে হাদিস বলা হয়ে থাকে তা মওযূ বা
জাল। এই সালাত ৪৪৮ হিজরিতে সর্বপ্রথম বায়তুল মূকাদাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়। যেমন
মীশকাত শরিফের খ্যাতনামা আরবী ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারি হানাফি কেতাবের বরাতে
বলেন, জুম্মা ও ঈদায়নের সালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সালাতে আলফীয়াহ নামে।
এই রাতে যে সালাত আদায় করা হয় এবং এর সাপেক্ষে যেসব হাদিস বলা হয় তার শবই
বানোয়াট ও মৌ্যূ অথবা যাইফ। পনের শাবানের রাতে আল্লাহ্ পাক দুনিয়ার নিকটবর্তী
আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের মানুষদের ছাগল পালের পশমের চেয়েও
অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।
শবেবরাতের রাতে কী রূহের আগমন হয়?
এই রাত্রিতে 'বাকী এ গারকাদ' নামক কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) এর
নিঃসজ্ঞ অবস্থায় যেয়ারত করতে যাওয়ার হাদীসটি (ইবনে মাজাহ হা/১৩৮৯) যে যইফ ও
মুঙ্কাতা তা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। এখন প্রশ্ন হল এ রাতে কি সত্যি সত্যিই
রুহুগুলো ইল্লিন বা সিজ্জিন হতে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে কি না।
যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি
মেয়েদের জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হলেও তাদেরকে এ রাতে কবরস্থানে দেখা মিলে।
এ সম্পর্কে সাধারনতঃ সূরায়ে কদর এর ৮ ও ৫ নং আয়াত দুটি পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে
বলা হয়েছে 'সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রুহু অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের
অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি ঊষার আরবিভাব কাল পর্যন্ত'। এখানে 'সে
রাত্রি' বলতে লায়লাতুল কদর বা শবেকদরকে বুঝানো হয়েছে যা এই সূরার ১ম,২য় ও ৩য়
আয়াতে বলা হয়েছে। অত্র সূরায় রুহু অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে বিধায় হয়তবা অনেকে
ধারনা করে নিয়েছেন যে মৃত বাক্তিদের রুহুগুলো সব দুনিয়ায় নেমে আসে। অথচ এই অর্থে
কোন বিধান করেননি।
শবেবরাতের সালাতুত তাসবীহ ও নামাজের নিয়ম
সালাতুত তাসবীহ অত্যত্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় নফল নামায। হাদীসে অনেক ফজিলত ও
সওয়াবের কথা বর্ণিত আছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) চার রাকাতে নামাযটি আদায় করার জন্য
নির্দেশ দিয়েছেন। এ নামাযের প্রত্যেক রাকাতে ৭৫ বার তাসবীহ পড়া হয়। এ জন্য এ
নামাযকে সালাতুত তাসবীহ বলা হয়। আপনি ৪ রাকাত নামায আদায় করবেন তাতে নিয়ম মোতাবেক
আউযুবিআল্লাহ, বিসমি্ললাহ ও সানা পাঠ করে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা পড়বেন যখন
প্রথম রাকাতে কিরাত শেষ করবেন তখন রুকুতে না গিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় এ বাক্যগুলো ১৫
বার পরবেন।
বাক্যগুলো হচ্ছে (সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহে ওয়ালাইলাহ
ইল্লালাহু আকবার)। তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবীহ পড়ে আবার সে বাক্যগুলো দশবার
পড়বেন তারপর রুকু থেকে দাঁড়িয়ে ১০ বার,তারপর সেজদায় গিয়ে সেজদার তাসবীহ পড়ে আবার
১০ বার পড়বেন। প্রথম সেজদা থেকে উঠে বসে আবার সে বাক্যগুলো দশবার পড়বেন। অতঃপর ২য়
সেজদায় গিয়ে পুনরায় ১০ বার পড়বেন। ২য় সেজদা থেকে উঠে বসবেন এবং বসা অবস্থায়
পুনরায় ১০ বার পরবেন। এভাবে প্রতি রাকাতে পরবেন।
শবেবরাতের দোয়া কি কবুল হয়?
রাসুল (সাঃ) বলেন পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হয়।
- জুম্মার অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত।
- কোরবানি ইদের পূর্ব রাত।
- ইদুল ফেতরের পূর্ব রাত।
- রজবের প্রথম রাত।
- পনেরো সাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।
শবেবরাতের রাতে যারা সালাত আদায় থেকে বঞ্চিত হয় তাদের কি কি গুনাহ হয়?
হাদীস শরিফে এ রাতের যেমন ফযীলত ও বরকতের কথা বর্ণিত আছে তেমন এমন কিছু গোনাহের
কথাও এসেছে যাতে লিপ্ত ব্যক্তি বরকত ও ফযী্লত থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা হল দুই
শ্রেণীর লোক ঃ প্রথমত যে হিংসা বিদ্বেষ রাখে। দ্বিতীয়ত যে অন্যায়ভাবে
কাউকে খুন করে। হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে শবে কদর ব্যতীত কোন
রাতই শবেবরাতের চেয়ে উত্তম নয়। এ রাতে আল্লাহ পাক দুনিয়ার আকাশে অবতরন করেন এবং
মুশরিক,হিংসুক, বিদ্বেষী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত ক্ষমাপ্রাথী সকল
বান্দাকেই ক্ষমা করে দেন।
এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন রাসুলে করীম
(সাঃ) এর নিকট জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে বললেন আজ শবেবরাত যে রাতে আল্লাহ পাক
বনু কালব গোত্রের বকরিসমূহের পশম পরিমান লোককে আগুন অর্থাৎ দোযখের শাস্তি হতে
মুক্তি দান করেন। কিন্তু মুশরিক, হিংসুক, আত্মীয়তা ছিন্নকারি, অসৎ আচরণকারী ,
মা বাবার অবাধ্য সন্তান এবং সর্বদা মদ্যপানকারীর ব্যক্তির প্রতি দয়াশীল
হন না।
শবেবরাতের কিছু কুপ্রথা
কোন পবিত্র জায়গা ও এমন কোন সময় নেই যেখানে শয়তান মানুষকে বরকত ও ফযীলত থেকে
বঞ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়নি।এ সকল স্থান ও সময়ে শয়তান কোন না কোন
বেদআতের প্রচলন অবশ্যই করে রেখেছে। সাথে সাথে এ সকল শরীয়তবিরধী কার্যকলাপে সে
এমন আকর্ষণীয় রং লাগায় যে নির্বোধ গাফেল ও মূর্খ লোকেরা সেদিকে আকৃষ্ট
হয়ে সে সকল কাজে লিপ্ত হয়ে বরকত ও ফযীলতের লাভের পরিবর্তে মারাত্মকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ পবিত্র রাতের জন্য এমন কিছু অহেতুক প্রথার প্রচলন ঘটানো হয়েছে যেগুলো
সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ফরয ওয়াজিবের মত গুরুতাররুপ করে আদায় করা
হয়। সকল বেদআত কর্ম থেকে সংক্ষেপে কয়েকটি আলোচনা করা হচ্ছে। যাতে এগুলো থেকে
সহজে বিরত থাকা যায়।
আতশবাজিঃ আতশবাজি, তারাবাজি, পটকা ইত্যাদি পরানো ও ফুটানো এদিনে বেনামাযীদের এক উৎসবে পরিনত হয়। এদের উপদ্রপে কোন দ্বীনদার মুসলমান রাস্তাঘাটে চলাফেরাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। এগুলো যে অহেতুক গোনাহ তা নয় বরং এর পার্থিব ক্ষতিও সর্বদা চক্ষুশীল হয়।
শাবান মাসের করনীয় কি কি কাজ?
রমাযানের আগের মাস হিসাবে শাবান মাসের প্রধান করনীয় হল অধিকহারে ছিয়াম পালন
করা। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন 'আমি রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) কে রামাযান ব্যতিত অন্য কোন
মাসে শাবানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। শেষের দিকে তিনি মাত্র
কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ করতেন।যারা শাবানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন
তাদের জন্য পনেরো দিন ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা
মানত করে থাকেন তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।
মোটকথা শাবান মাসে অধিক হারে ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। ছহীয় দলীল ব্যতিত কোন দিন
বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য যারা
'আইয়ামে বীয' এর তিন দিন নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই
শাবানে উক্ত নিয়মেই ছিয়াম পালন করবেন শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হলে
কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা বিদআতি কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না। এবং
সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার দান করুন!
আমিন!
লেখকের মন্তব্যঃ শবেবরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে জানুন
পরিশেষে একটি বিষয়য়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আলোচনার ইতি টানতে চাই। কোন
একটি নির্দিষ্ট রাত্রি বা দিবসকে শুভ অশুভ গণ্য করা ইসলামী নীতির বিরোধী। রাত্রি
ও দিবসের স্রষ্টা আল্লাহ। তাই কোন একটি রাত বা দিনকে অধিক মঙ্গলময় হিসাবে গণ্য
করতে গেলে সেখানে আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই জরুরী 'অহি' ব্যতিত মানুষ এ ব্যাপারে
নিজে থেকে কোন সিধান্ত দিতে পারে না। যেমন কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমে আমরা লায়লাতুল
কদর ও মাহে রামাযানের বিশেষ মর্যাদা এবং ঐ সময়ের ইবাদাতের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে
জানতে পেরেছি। সন্মানিত পাঠকবৃন্দ আমার এই পোস্ট থেকে আপনি বেশ কিছু জেনেছেন এবং
সব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিয়েছি। আপনি এই পোস্টটি পরে উপকৃত হলে পরিচিতদের সাথে অবশ্যই
শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।
দিয়া ক্র্যাফট হোম নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url